শুক্রবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

এমনও কিছু স্বপ্ন থাকে শুধু নীরবে কাঁদার ৷

মেয়ে : বাবা, তুমি ঘন্টায় কত টাকায় আয় কর?
বাবা: (স্তম্ভিত হয়ে) কেন সেটা দিয়ে তোমার কী দরকার?
মেয়ে: দরকার আছে বাবা, প্লিজ বল না...!
বাবা: ২০০ টাকা।
মেয়ে: আমাকে সেখান থেকে অর্ধেক ধার দিতে পারবে?
বাবা: (রেগে গিয়ে) দেখ, আমি অনেক কষ্ট করে টাকা রোজগার করি, তুমি যদি ভেবে থাকো আমার সেই টাকা ধার
করে খেলনা কিনবে, তাহলে খুব খারাপ কাজ করেছো। এখন বরং ঘুমাতে যাও।
.
বাবার রাগ কিছুক্ষণ পর নেমে গেলো। তিনি ভাবতে লাগলেন- হয়তো অন্য কোন কাজে টাকাটা মেয়ের আসলেই দরকার। তিনি মেয়ের ঘরের দরজায় নক করলেন-
.
বাবা: ঘুমিয়েছিস মা?
মেয়ে: না, বাবা।
বাবা: এই নে, আমি তোর জন্য ১০০ টাকা নিয়ে এসেছি।
.
মেয়ে দরজা খুলে দিলো, তার হাতে একটা কাঁচের বৈয়ামে অনেকগুলো খুচরো টাকা। দেখে বাবার মেজাজ আবারো খারাপ হয়ে গেল...
.
বাবা: তোমার কাছে তো দেখছি যথেষ্ট টাকা আছে, তারপরও তুমি আমার কাছে টাকা ধার চাইলে কেন?
মেয়ে : না বাবা , আমার কাছে যথেষ্ট টাকা ছিলো না; তোমার ধার দেয়া ১০০ মিলিয়ে হয়েছে। এই নাও
বাবা, এখানে ২০০ টাকা আছে। তুমি কী আগামী কাল এক ঘণ্টা আগে ঘরে ফিরে আমার সাথে রাতের খাবার খেতে পারবে??
.
তারপর আমাকে একটা গল্প শোনাবে, আমাকে জড়িয়ে আদর করবে... বাবা তার মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন।
-------------------------
কাদের জন্য এত কষ্ট করছেন? একবারও কী জানতে চেষ্টা করেছেন, তাঁরা আসলে কী চায়? সম্মানিত অভিভাবকদের কাছে প্রশ্ন রাখলাম?

জীবন একটু বেশীই বর্ণিল!!

যে মেয়েটা ঘামের দূর্গন্ধ শুনলে বমি
করে দিত সেই
মেয়েটাই এখন দরজার ওপাশে দাড়িয়ে
থাকে কারো
গায়ের ঘামে ভিজা শার্টটা বারান্দায়
নিয়ে শুকাতে দেয়..
.
যে মেয়েটাকে বিয়ের আগে কেউ
খাইয়ে না দিলে
খেতে চাইতনা সেই মেয়েটাই এখন কারো
জন্য খাবার
বেড়ে বসে থাকে কারণ প্রিয় মানুষটার
মুখে খাবার না
দিয়ে খাবার পেটে যায়না।
.
যে মেয়েটার ঘর সবসময় অগুছালো
থাকতো
সেই মেয়েটি এখন পুরো একটা পরিবার
গুছায়
ঘরের প্রতিটি কোণায় কোণায় তার
পদার্পন কারন সে
এখন মেয়ে নয় কারো ঘরের বউ।
.
যে মেয়েটার ঘুম ভাঙ্গার জন্য মা
প্রতিদিন বকা দিত
সেই মেয়েটিই এখন বাড়ির সবাইকে
ডেকে তুলে কারণ
এই বাড়িতে তাকে সবার আগে ওঠতে হয়.
.
যে মেয়েটা বাচ্চাদের পায়খানা
দেখলে দশ হাত দুরে
থাকতো সেই মেয়েটিই এখন ন্যাপকিন
নিয়ে বাবুর
পিছনে দৌড়ায় কারণ সে এখন একজন মা।
.
যে মেয়েটা হাঁস মুরগীর বিষ্ঠা দেখলে
একসময় নাক
ছিটকাতো সেই মেয়েটি এখন তলপ্রদেশে
হাত দিয়ে
দেখে ডিম আছে কিনা
কারণ ছোট্ট সোনামণিটা যে ডিম খেতে
বড্ড
ভালবাসে।
.
যে মেয়েটা কখনো রান্নাঘরে ওকি
দিয়েও দেখেনি
সেই মেয়েটাই এখন রান্নাঘরের শ্রেষ্ঠ
রাধুনী যার
হাতের রান্না না খেলে পরিবারের
কারোর তৃপ্তির ডেকুর
ওঠেনা।
.
যে মেয়েটা একসময় প্রচুর হাতখরচ করতো
বাবার কাছে
এইটা সেইটার বায়না ধরতো সেই মেয়েটা
এখন অনেক
কৃপন হয়ে গেছে কারন সে বুঝতে শিখেছে
তারও এখন
একটা সংসার আছে।
.
এই মেয়েগুলো আর কেউ না আপনার আমার
মা, মেয়ে,
বোন, আবার কারো সহধর্মীনিও
আসলে মেয়েগুলো জন্মগতভাবেই
পরিবর্তনশীল হয়
বাপের সংসার থেকে স্বামীর সংসার
এরই মধ্যেই
তাদের জগতসংসার ।
.
মেয়েগুলোকে ভালোবাসতে শিখুন তারা
যতোই খারাপ হোক না কেনো তারই
কিন্তুু আপনার জীবেনর সবকিছু..
জন্ম হতে মৃত্যু পর্যন্তই কোনো না কোনো
মেয়েই আপনার পাশে থাকবে আপনাকে
সাহায্য করার জন্য....
জন্মতে মা এর আদর...
তারপর বোনের আদর....
তারপর কোনো মেয়েকে
ভালোবাসলেন....
তারপর বিয়ে করলেন.....
তারপর কোনো মেয়েই আপনার বউ হলো...
তারপর আবার আপনার মেয়ে হলো...
হয়ত বৃদ্ধ বয়সে আপনার বউ আগেও মারা
যেতে পারে..
তখন আপনার মেয়েরাই হয়ত দেখাশুনা
করবে....
তাহলে কেনো সেই মেয়েদেরকে আপনি
খারাপ বলবেন..
মেয়েদেরকে আপনি বুঝান আপনি পারেন
তাদের বুঝাতে..কারন মেয়েরা একমাএ
আপনার শাসন কে ভয় পায়....

কিছু বিচ্ছুর থেকে বোধ হয় ক্যানসার অনেক ভালো

Tahmida Jannat নামের এই মেয়েটা কিছুদিন আগে মারা
গেছে ক্যানসারে ।
তার FB আপডেট গুলো আমার বন্ধু তালিকার একজন
শেয়ার করেছে ।
পড়ে শেয়ার না করে পারলাম না ।
বাস্তবতা কি জিনিস, তা দেখিয়ে দিয়ে গেলো......
.
৭-৩-২০১৩.........
আজ আমার ক্যান্সার জীবনের সপ্তম দিন । খবরটা আব্বু
আম্মু আমাকে দেয়ার সাহস করে নাই । সারিন আমাকে
জানায় আমার লিউকেমিয়া ।
কিভাবে নিব ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলাম না । আমিতো
ক্যানসারকে চাই নাই ।
তাহলে সে কেন আসলো আমার কাছে । আমিতো অন্য
কাউকে চেয়েছিলাম...
যাহা পাই তাহা চাইনা ।
.
১৩-৭-২০১৩.........
শেষ পর্যন্ত স্কুলে যাওয়াও বন্ধ হল আমার । ব্লিডিং
বেড়ে যাচ্ছে । কি অদ্ভুত । একসময় জ্বরের ভান করে পড়ে
থাকতাম । আর এখন স্কুলে যাওয়ার জন্য সুস্থ থাকার
অভিনয় করতে হয় । পোয়েটিক জাস্টিস ।
ক্যান্সার মনে হয় একটা মানুষের অতীতের সব খোজ খবর
নিয়ে আসে । এই যে একসময় বৃষ্টি ভালো লাগত না ।
কিন্তু এখন যেন বৃষ্টিকেই আপন মনে হয় । রোদ অসহ্য
লাগে । রোদ আমাকে আমার অক্ষমতার কথা মনে করিয়ে
দেয় ।
.
২২-৯-২০১৩.........
আজ আমার বন্ধুরা আমাকে দেখতে এসেছিল । ঐশি,
মৌমিতা,সানি, রিয়ন । অনেকদিন পর একটা ভালো সময়
কাটালাম । কিন্তু কোথায় যেন সুরটা কেটে গেছে ।
আমি জানি ওরা আমায় প্রচন্ড ভালোবাসে । সানি
আমার চোখের দিকে তাকাচ্ছিল না। লজ্জায় বোধহয় ।
সম্পর্কটা শেষ হয়েছে প্রায় তিনমাস । আমার
ক্যান্সারের কথা শুনে সানিই আস্তে আস্তে দূরে সরে
যায় । আমি জানি ও আর মৌমিতা প্রেম করা শুরু করেছে
। খারাপ লেগেছে ওরা আমাকে খোলা মনে ব্যাপারটা
জানালেই পারত। সত্যি কথা শোনার অধিকার কি
থাকেনা একজন ক্যন্সার রোগীর । সবাই এমন অভিনয়
করে কেন ?
.
১৬-১-২০১৪.........
অনেকদিন লিখিনি । অনেক দেরি হয়ে গেছে । রোগটা
আমাকে গ্রাস করে ফেলছে । ইদানিং সানিকে খুব মনে
পড়ে । ওকে ফোন দেই ধরেনা । ক্যান্সার তো ছোঁয়াচে
না । তবে কেন এত অবহেলা । আজকাল রিসানের সাথে
কথা বলে সময় কাটে আমার। ছেলেটার সাথে আমার
ফোনে পরিচয় । কোন শর্ত ছাড়াই ভালোবাসে আমায় ।
কিন্তু আমার কিছু করার নেই । একজন ক্যান্সার রোগীর
কাউকে ভালোবাসার কিংবা কারো ভালোবাসা
পাওয়ার অধিকার নেই ।
.
২৬-১-২০১৪.........
দ্বিতীয় কেমো দিয়ে বাসায় আসলাম । চুলের ব্যপারে
সবসময় একটু বেশি খুত খুতে ছিলাম আমি । নতুন নতুন
ব্র্যান্ডের শ্যাম্পু কন্ডিশনার কিনতাম । এখন আর ওসবের
প্রয়োজন হয়না । চুলই নেই, শ্যাম্পু দিয়ে কি করব ।
কাজের বুয়াকে বলে ড্রেসিং টেবিলটাকে ঘর থেকে
বের করে দিয়েছি । আয়নায় তাকাতে ভালো লাগেনা ।
এদিকে আব্বু আম্মুর মধ্যে ঝগড়া বেড়েই চলেছে দিন দিন
। এই সম্পর্ক বেশিদিন টিকবে না আমি জানি । ওইদিন
মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে দেখি আব্বু আমার পায়ের কাছে
বসে কাদছে । ভালোবাসার বিয়ের এ কি পরিণতি ।
ভালোবাসার থেকে বোধহয় ক্যান্সারও ভালো...
.
২-২-২০১৪.........
২৬ ঘন্টা পর আমার জ্ঞ্যান ফিরল । রিসানের সাথে
ঝগড়া করলাম অনেকক্ষন । ওর সাথে ঝগড়া করতে আমার
ভালো লাগে । ঝগড়া করার কেউ থাকা লাগে জীবনে ।
না হলে বেঁচে থাকাটাই বৃথা...
.
১৩-৩-২০১৪.........
গত ৪৮ ঘন্টায় আমায় নিয়ে যমে ডাক্তারে টানাটানি
হয়েছে । আমি আমার সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করেছি
ডাক্তাররা যাতে জিতে । কিন্তু জানি শেষ পর্যন্ত
জয়টা ক্যান্সারের হবে । লিখার শক্তি পাচ্ছিনা...
সানিকে অনেক মিস করছি । যদিও মিস করাটা উচিত না
। ক্যান্সার রোগীদের কাউকে মিস করার অধিকার
নেই...
.
২৫-৫-২০১৪.........
এই লিখাটাই বোধহয় আমার শেষ লেখা হতে যাচ্ছে ।
শেষ শক্তিটুকু জমিয়ে লিখাটা লিখছি । আমার রেখে
যাওয়া জিনিসের মধ্যে ডায়রিটা রিসানের ভাগে
পড়েছে । ছেলেটার মধ্যে মানুষের মুখে হাসি
ফোটানোর ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতা আছে । ও অনেক ভালো
থাকুক । লিখতে লিখতে চোখের কোণে জল জমে
একফোটা । এই জলটা কার জন্য । জানিনা । খুব মিস করব
। বাবা মাকে, আমার ছোট্ট বোনটাকে । বন্ধুদের মিস
তো করবই । সানি ভালো থাকুক । স্কুলের সামনে যে
মামাটা আচার বিক্রি করত, তাকেও মিস করব অনেক ।
আচ্ছা, স্বর্গে কি আঁচার বিক্রি হয় । মনে হয়না ।
আরেকটা দিন বেঁচে থাকার শখ ছিল । আফসোস ।
যাহা চাই তাহা পাইনা ।
.
অবশেষে মে মাসের ২৭ তারিখে তার যুদ্ধটা শেষ হয় ।
আল্লাহ তাকে ভালো রাখুক ।

অামাতেই সীমাবদ্ধ অামি !!

নিজের সম্পর্কে কিছু বলা সব সময়ই কঠিন একটি কাজ..আমি কি চাই , আমার স্বপ্ন কি , আমার দুর্বলতা কি - এগুলো অল্প কথায় গুছিয়ে লেখা কঠিন এবং কষ্টকর । তাছাড়া আমি নিজেকে বর্ণনা করতে গেলে তা শতভাগ নির্ভূল না হবার সম্ভাবনাই বেশি কেননা আমার সব দোষ গুন সম্পর্কে আমি অবহতি নই । আবার , আমি হয়তো আমার কিছু দোষকে এড়িয়ে যেতে পারি এবং কিছু গুনকে বাড়িয়ে বলতে পারি । ( আমি তো একজন মানুষ ,ফেরেশতা নই ,তাই না ? ) এই কাজটি আমার চেয়ে ভালো পারবে আমার আশেপাশে থাকা কেউ ।

যাই হোক, তারপরও নিজেকে আমি নিশ্চিতভাবে একজন সৎ, আন্তরিক , কর্মঠ , Friendly, Caring, Entertaining ব্যক্তিত্ব হিসবে চিত্রিত করতে পারি ।নেতিবাচক দিকগুলো বলতে গেলে - আমি কখনো কখানো অতিরিক্ত সরল , আবেগপ্রবণ , যেকাউকেই সহজে বিশ্বাস করি , কিছুটা Childish, কিছুটা Immature. আমি শারীরিক দিক দিয়ে দক্ষ । একসময় যথেষ্ট চিকন ছিলাম এখনো অাছি । অাবার অামার উচ্চতাও একটু কম, তাইতো Xgf পাত্তা দিলো না ৷ কিন্তু প্রচুর পরিশ্রম করে আজকের এই অবস্থায় এসেছি । ওহ্ , আরেকটি কথা বলতে ভুলে গেছি , আমি খেতে পছন্দ করি । কিন্তু কম খেতে চেষ্টা করি । কেননা আমি আগে যেমন চিকন ছিলাম সেই রকম Figure আবার ধরে রাখতে চাই । একারনে প্রায়ই আমাকে নিজের সাথে যুদ্ধ করতে হয় কম খাওয়ার জন্য ।

ধর্ম বিষয়ে বলতে গেলে, আমি একজন মুসলমান এবং আল্লাহকে বিশ্বাস করি ও ভয় করি ; কিন্তু আমি গোড়ামি এবং ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা করাকে ঘৃণা করি ।

আমি সেই সকল মূল্যবোধকে অণুসরন করি যার মধ্যে আধুনিকতা এবং ধর্মের সমন্বয় রয়েছে । পারিবারিক মূল্যবোধ আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অবশ্যই আমি আমার দেশের সংস্কৃতিতে গর্ববোধ করি ।

আমি নিজেকে একজন আধুনিক ব্যক্তি বলে মনে করি । তবে আধুনিকতা মানে এই নয় যে, আমি আমা্র সংস্কৃতি ও ধর্মকে ত্যাগ করবো এবং অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করবো । আধুনিকতা বলতে আমি বুঝি - অন্যের অনুভূতিকে সম্মান করা , জীবনকে উপভোগ করা কিন্তু কোনো কিছুর সীমা অতিক্রম না করা এবং সর্বোপরি চিন্তা ভাবনায় আধুনিক হওয়া ।

আমি টিভি দেখতে , গান শুনতে , গণ্প করতে এবং নেটে সময় কাটাতে পছন্দ করি । আমি এখনো সিঙ্গেল এবং মিঙ্গেল হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি । আমি একজন 'One Woman Man' হতে চাই এবং একজন 'One Man Woman ' কে পেতে চাই । যার অর্থ , No Extra Marital Affair.

আমি Self Improvement এ বিশ্বাস করি এবং নিজের মধ্যে যেসব দোষ / বাজে দিক আছে , সেগুলোকে সবসময় Overcome করার চেষ্টা করি । আমি বিশ্বাস করি - " It's Not that How Good you are ....It's How Good You Want to be "

এই হচ্ছে মোটামুটিভাবে আমি -আমার কিছু অংশকে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম । আমার সম্পর্কে আরো জানতে চাইলে আপনাকে স্বাগতম । আসুন, আমাকে Explore করুন এবং আমাকেও আমার সম্পর্কে জানান । কারন - যেটা শুরুতে বলেছি আমার অনেক কিছুই আমি জানিনা ।

নেশা !

"নেশা"

বাপজান,
আশাকরি কুশলেই আছেন
পর সমাচার এই যে....,
সেদিন আপনি যে কান্ডটি করিলেন
তার জন্য এই পত্রটি না লিখিয়া পারিতেছি না।
দেখিতেছি যতই বয়স বাড়িতেছে,ততই আপনার কান্ডজ্ঞান
একেবারেই লোপ পাইতেছে।
আপনি কি করিয়া সেদিন-আমার ড্রইংরুমে
অর্থাৎ বৈঠকখানায় বেমোক্কা ঢুকিয়া পড়িলেন,
বুঝিলাম না
সারাগায়ে ঘামের গন্ধ,ময়লা তেল চিপচিপে পান্জাবী
বগলে ছেঁড়া ছাতা,মাথায় চিতিপড়া কিস্তি টুপি,
যেন,আকবর বাদশার ঊষনিশ আর-কি।
হাতে মাটির হাঁড়ি,সর্বোপরি দু'পায়ের চামড়ার
কুচকুচে কালো রং,বোধহয় লজ্জায় ঢাকিয়া ফেলার আশায়
রাস্তার সবটুকু ধূলি মাখাইয়া
পা দু'টি কে মনে হইতেছিলো চুনকাম করাইয়াছেন।
কী লজ্জা,আপনার ঐ মূর্তি দেখিয়া আমার বন্ধুগন
এবং তাদের সুন্দরী স্ত্রী'রা,বজ্রাহতের মত তাকাইয়া রহিল।
যেন তারা চাক্ষুষ ভূত দেখিতেছে।

আর-আমার অবস্থাটা একবার ভাবিয়া দেখুন,
মান,সন্মান,মর্যাদা সব জাহান্নামে গেল
তাও না হয়,আপনি যদি দয়া করিয়া একটু চুপ থাকিতেন
তবু একটা কথা ছিলো।
তা- না,আপনার আবার আহল্লাদে মুখ দিয়া
কথার ফোয়ারা ছুটিতে লাগিলো-
বাবা,কেমন আছো? বৌমা কোথায়?
বলিহারি, ভাগ্যিস সেই মূহুর্তে ও সেখানটায় ছিলোনা
থাকিলে তো বেচারীর হার্ট এ্যাটাক হইয়া যাইতো,
সেতো আবার হঠাৎ কোন খারাপ দৃশ্য
মোটে ও সহ্য করিতে পারেনা,
বড় কোমল হৃদয়ের মানুষ কিনা।
বাপজান,তোমারে আমি সাবধান করিয়া দিতেছি
আর যাই করো,এইভাবে আমাকে ডুবাইওনা,
টাকা পয়সা লাগিলে চিঠি দিও,পারিলে পাঠাইবো,
আর- এত টাকা পয়সা ও যে কেন লাগে তোমাদের
তাও বুঝিনা।

তোমাদের আবার এত খরচ কীসের
ক্লাবে যাওনা,পার্টি দাওনা
ইসুবগুল আর চিরতার পানি ছাড়া
আর তো কোন নেশা ও করোনা।

এইটুকু পড়িয়া দরিদ্র স্কুল মাষ্টার পিতা
আনমনে বলিয়া উঠিলেন:-

"নেশা একটা আছে,বড় পুরোনো নেশা
কিছুতেই ছাড়তে পারিনা সেই নেশা
তোর জন্মের পর থেকে সারাক্ষন তোকে দেখার নেশা
কিছুতেই ছাড়তে পারিনা বাপ
কিছুতেই ছাড়তে পারিনা.......

বৃহস্পতিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

এই মেঘ, এই রোদ্দুর !

আজকাল ঘুনে ধরা মন অকারণেই অস্থির থাকে। সুন্দর পৃথিবীর সব কিছুই অসুন্দর লাগে। ভাল লাগার অনুভুতি কখনো কিঞ্চিতের জন্য ফিরে আসে। আবার মুহুর্তেই চলে যায়। তখন প্রভাতের নীলে চোখ রাখলে মনে বেজে উঠে হাজার সুরের অনুরণন। যত আঘাত, যত কষ্ট, হৃদের রক্তক্ষরণ, কথার আঘাতের দগদগে ঘা নিমেষেই উড়ে ভোরের নীলে চলে যায়। চোখের আকাশে রঙধনু উঠে.... হাজার রং ছড়ায়ে... বৃষ্টি ঝরে রংধনু রংয়ের। বৃষ্টির ফোঁটা সবুজ ঘাসে মুক্তো হয়, আংগুলের ডগায় মুক্তো তুলে নিয়ে কপালে টিপ এঁকে দেই। দুটি নীল ফড়িং উন্মাতাল উল্লাসে সবুজ ঘাসে উড়ে বেড়াচ্ছে। ভালবাসার পরশ বুলাচ্ছে একে অপরে। লেজ উঁচিয়ে বুলবুলি এ ডাল ও ডালে কখনো সবুজ ঘাসের গালিচায় নেমে ক্ষিদে মিটিয়ে উড়ে বসছে ডালে। প্রজাপতি, ফড়িং, বুলবুলি আমার সখি হয়। 

শোন, তোমরা প্রতিটি সকালে এমন করেই এসো আমার আঙ্গিনায়, ছড়িয়ে দেব তোমাদের জন্য ভালবাসার শস্যকণা। মুগ্ধ চোখে আনন্দ কুঁড়িয়ে নিব আঁচল ভরে। 

আমার রাত কখনো হয় না নির্ঘুম। হতাশা আসে সব দিনের আলোয়। হিসাব বুঝি তাই মেলে না। হিসাব আমি বুঝি না। এত চুলচেরা বিশ্লেষন করি না হতাশার। কারণ এসবের সমাধান নেই। ভুলে যাই সব। কখনো দুপুরকে বানাই প্রভাত... প্রভাতের স্নিগ্ধতায় নিজেকে বিলিয়ে দেই। কোন তীক্ষ্ণ আলোর অপেক্ষায় থাকি না। আলো নিজে তৈরী করে নেই মনের মাঝারে....চোখ খোলা রাখি অহর্নিশ...আলো যেন নিভে না যায় কভু। এই মেঘ জমে আমার মনের আকাশে আবার রোদ্দুরের ঝলমলে ছোঁয়ায় মেঘ যায় কেটে। তাই আমি হয়ে যাই এই মেঘ এই রোদ্দুর।

শুক্রবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

অবিনাশ'

যান্ত্রিকতা কি যন্ত্রের জন্য? নাকি যন্ত্রটা সৃষ্টি হয়েছে যান্ত্রিকতার জন্য? যন্ত্র আর যান্ত্রিকতার পরেই সৃষ্টি হয়তো যন্ত্রাংশ কিংবা যন্ত্রনার। কার তরে কার বসবাস বলতে পারাটাও এক ধরনের যান্ত্রিকতা। যান্ত্রিকতার ধারায় জর্জরিত হতে হতে একটা সময় সেই মানুষটা যন্ত্র হয়ে যায়, সেই যন্ত্রটা তখন যান্ত্রিকতায় আবর্তিত না হয়ে যন্ত্রাংশ হয়ে দেখা দেয়। ওয়াশিং মেশিন দিয়ে যেমন ফটোকপি হয় না ঠিক তেমন ফটোকপি মেশিন দিয়ে ওয়াশিং হয় না। মনটা যখন যান্ত্রিকতায় পড়ে যন্ত্র হয়ে যায় তখন তার মাঝে আর অবশিষ্ট ভালবাসা গুচিয়ে রাখাটা সম্ভব হয়ে ওঠে না, থাকে শুধু প্রয়োজনীয়তার আবসান মিটানো। বাবা মায়ের খুব আদরের মাঝে বেড়ে উঠা ছেলেটা, যে নাকি কখনো কস্ট আর অভাব দেখেনি। সেই ছেলেটাই যখন বাস্তবতার তাড়নায় কোনো এক ঝড়ে এলোমেলো হয়ে যায়, তখন সভ্য জগৎ তার কাছে অসভ্য মনে হয়,প্রেম ভালবাসা গুলো লাগে কৌতুকের মত। না বলছি না তার মাঝে ভালবাসা নেই, অবশ্যই থাকে তবে সেই ভালবাসাটা চাপা পড়ে যায় যন্ত্র,যান্ত্রিকতা কিংবা যন্ত্রনার রসাতলে।

সকল কিছুকে চাপা দিয়ে সেও চায় ফিরে যেতে মধুর সময়ে,ফিরে পেতে চায় কিছুটা আবেগ, ফিরে পেতে চায় আদর মাখা যত্ন কিংবা কোমল হাতে আগলে ধরা কাউকে।
কাছে পেতে চায় ভাল লাগা প্রিয় মানুষটাকে কিন্তু ভাগ্য মহাশয় হয়তো বারবার মুচকি হেঁসে জানান দিয়ে যায় বধিরের জন্য যেমন হেডফোন নয়। অন্ধের জন্য যেমন চশমা নয় তেমনি বোবার জন্য স্পিকার নয় ঠিক যন্ত্রের জন্য ভালবাসা নয়। একে পর এক,আবার দুয়ের পর এক, হারানোর সংখ্যা যখন যোগফলে যোগ হয় তখন একটা সময় এসে আর হিসেব মিলাতে বসা হয় না। যুক্ত হবে এটাই নিয়তির ফলাফল।

তাই কেউ যদি বলে নতুন করে কিছু হারাতে হবে তখন অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চোখের কোনে জমাট বাধা জল রাশি মুছে মলিন একটা হাঁসির আঁড়ালে লুকিয়ে বলতে হয় আমার কিছু নেই হারাবার। নতুবা আমারতো কিছু ছিলোই না হারানোর ভয় কিসের? প্রশ্নের জবাব নেই, প্রশ্নবোধক চিহ্নটা কথামালার শেষে এসে দাঁড়িয়ে যাবে,জবাবহীন যান্ত্রিকতায় ভুলে যেতে হয় হারিয়ে ফেলার যন্ত্রনা কিংবা অলিখিত গল্পে যোগফলের সংখ্যাটা বেড়েই যাবে। আমি হিসেব না করে যন্ত্র মানব হয়ে বেঁচে রবো হয়তো আর কয়েকটা দিন কিংবা অল্প কিছু সময়। তারপর হারিয়েই যাবো নিজের মত করে এই যান্ত্রিকতার শহর থেকে দূরে বহু দূরে।

বৃহস্পতিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

প্রেম: জীবনে ও সাহিত্যে

মানব সভ্যতা ও বিজ্ঞানের এই চরম উৎকর্ষতার যুগেও ‘প্রেম’ নিয়ে কৌতূহল ও রহস্যময়তার শেষ নেই। ‘প্রেম কী’-এর অনুসন্ধান এখনো চলছে। মধুর স্বাদ যে ব্যক্তি কখনো লাভ করেনি, তাকে যেমন চিনি ও গুড়ের মিশেলে মধুর স্বাদ বোঝানো যাবে না, তেমনিভাবে ‘প্রেম কী’ জানতে হলে খোদ প্রশ্নকর্তাকেই প্রেমে পড়তে হবে। প্রেমের সত্যিকার উপলব্ধি অর্জন করা কেবল তখনই সম্ভব।

তবে প্রেমের কোনো সংজ্ঞা না থাকলেও প্রেম নিয়ে নানা ধরনের মিথ্যা ও ব্যাখ্যা প্রচলিত আছে। বিপরীত লিঙ্গের নির্দিষ্ট একজনের প্রতি পূর্ণ আসক্তিকেই প্রেমের বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করেন মনোবিজ্ঞানীরা। সবকিছু ত্যাগ করে যে ভালবাসা রবীন্দ্রনাথ তাকেই ‘প্রেম’ বলেছেন। বিপরীত সত্তাকে মহার্ঘ্য অনুভব করে আপন সত্তাকে সমর্পণের আকুতিই মানব-মানবীর প্রেমের প্রথম ও প্রধান নির্দেশক।

কবির ভাষায়— “আমি তোমাকে ভালবাসি অস্থিমজ্জাসহ।” সত্যিকারের প্রেমের প্রকাশ এটাই।

‘প্রেম’ না ‘ভালবাসা’

সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘প্রেম’ না ‘ভালবাসা’ —এমন প্রশ্নও উঁকি দেয় অনেকের মনে। একজন নর কিংবা নারী যখন বিপরীত লিঙ্গের কাউকে বলেন, ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’; তখন সেটা আসলে প্রেমেরই নির্দেশক।

তবে ‘ভালবাসা’ শব্দটির ব্যাপ্তি অনেক। এখানে বহুজনকে জায়গা দেওয়া সম্ভব। ভালবাসা যদি হিমালয়ের পাদদেশ হয়, প্রেম হলো এর চূড়া। যদি আরেকটু সহজ করে বলি— তাহলে বলা যায়, ভালবাসা হচ্ছে, রেলের একটি কম্পার্টমেন্টের মতো, এখানে বহু লোক একসঙ্গে বসতে পারে। আর প্রেম হচ্ছে, রিকশায় চড়ার মতো, এখানে দু’জন নর-নারী স্বাচ্ছন্দ্যে বসতে পারে। ভালবাসা নিঃস্বার্থ ও শর্তহীন হতে পারে। অন্যদিকে সত্যিকারের প্রেম নিঃস্বার্থ হলেও নিঃশর্ত নয়।

“ভালবাসা এক তীব্র অঙ্গীকার, যেন মায়াপাশ/সত্যবদ্ধ অভিমান ... ” (সত্যবদ্ধ অভিমান/সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)

অনেককেই ভালবাসা যায়, কিন্তু সবার সঙ্গে প্রেম হয় না। ভালবাসার সবচেয়ে গভীরতম স্তরটি হচ্ছে প্রেম। প্রেম হয় শুধু একজনের সঙ্গে। এ প্রসঙ্গে কেউ কেউ একাধিক প্রেমের কথা বলেন। কারো জীবনে একাধিকবার প্রেম আসতেই পারে। কিন্তু একই সঙ্গে একাধিক প্রেমে যারা বিশ্বাসী— সেই সম্পর্কগুলো অবশ্যই প্রেম নয়, অন্যকিছু। কারো কারো কাছে এটা নেশা বা খেলার বস্তু।

প্রেমে পড়ার কি কোনো বয়স আছে? এক কথায় এর জবাব হচ্ছে— ‘না’। একজন মানুষের ভেতর প্রেমের অনুভূতিগুলো যখন প্রথম জাগ্রত হয় কিংবা যখন সে এ ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠে; তখন থেকেই সে অবচেতন মনে নিজের প্রিয় মানুষটিকে খুঁজে বেড়ায়।

লাবণ্য’র সঙ্গে দেখা হওয়ার পর অমিত রায় বলছে, “সেই শৈশব থেকে সমস্ত দিন যেন অবচেতন মনে তোমার পায়ের শব্দ শুনে আসছি। মনে হয়েছে, কত অসম্ভব দূর থেকে যে আসছো —তার ঠিক নেই। শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছুলে তো আমার জীবনে।” (শেষের কবিতা/রবীন্দ্রনাথ)

অন্যদিকে কবিতায় যদি দেখি, বনলতা সেনের দেখা পাওয়ার জন্য হাজার বছর পথ হেঁটেছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। তিনি লিখেছেন- “হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে/সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে/অনেক ঘুরেছি আমি … /… দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন’?/পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।” (বনলতা সেন)

গ্রিক উপকথা অনুযায়ী, প্রেমের দেবী আফ্রোদিতির ছেলে দেবতা কিউপিড যখন কাউকে লক্ষ্য করে তীর ছোঁড়েন বা কাউকে তিরবিদ্ধ করেন তখন ওই মানব কিংবা মানবীর ভেতর প্রেমের ক্রিয়া শুরু হয়। বিজ্ঞানীদের মতে, মানুষ যখন প্রেমে পড়ে, তখন সে একটা ঘোরের মধ্যে থাকে। এটাকে বলা হয় ‘অবসেশন পিরিয়ড’ (ঘোর লাগা সময়)।

যে কোনো প্রেমের সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ বা দেখা হওয়াটা একটা পূর্বশর্ত। ‘প্রথম দর্শনেই প্রেম’ (ফার্স্ট সাইট লাভ) বলে একটা কথা চালু আছে। তবে এটাকে ঠিক প্রেম বলা যায় না; এটা আসলে এক ধরনের মুগ্ধতা। আগেকার দিনে একজন আরেকজনকে না দেখে শুধু চিঠিপত্রের (পত্র-মিতালী) মাধ্যমে বা লেখালেখির সূত্র ধরে প্রেমে পড়েছেন— এমন নজির আছে। তবে এসব প্রেমের স্থায়িত্ব কিংবা পরিণতি বা সফলতার ইতিহাস খুব বেশি নয়।

প্রেমের ক্ষেত্রে দেখা হওয়াটা যেমন পূর্বশর্ত, তেমনি প্রেমের বহিঃপ্রকাশ তথা ভালবাসার মানুষটিকে মনের কথাটা বলতে পারা কিংবা তাকে জানানোটাও খুব জরুরী। শুধু নিজের ভালবাসার কথাটি প্রিয়জনকে বলতে না পারার কারণে অতীতে বহু প্রেমের মৃত্যু ঘটেছে। এমন ঘটনা হয়তোবা এখনও ঘটছে।

প্রেমকে যেমন সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞায় ফেলা যায় না, তেমনি বিপরীত লিঙ্গের নির্দিষ্ট একজনের প্রতি কেন আরেকজনের প্রবল আকর্ষণ— এরও কোনো সঠিক ব্যাখ্যা নেই।

কবি বলেছেন, “কেন তাকে ভালবাসি/এ প্রশ্নের মিলবে না কোনো সদুত্তর/এমন কোনো জাল নেই —যা দিয়ে আটকে রাখা যায় তাকে ...”

একজন মানুষ কখন, কোথায় ও কীভাবে প্রেমে পড়বে এটা আগে থেকে কেউই বলতে পারে না। কখনো কখনো প্রেম হয়ে ওঠে মানুষের নিয়তি ও পরিণতি।

সব্যসাচী সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হকের ‘তুমি সেই তরবারি’ উপন্যাসের নায়ক বেলাল তার প্রেমে পড়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছে, “প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়িনি আমি। অনেকদিন থেকে চেনা ছিল। তখন স্বপ্নেও ভাবিনি, এই মানুষটির জন্যেই আমার অপেক্ষা, আমার গড়ে ওঠা। একটু একটু করে সে আমার সর্বস্বের সঙ্গে এক হয়ে গেল। স্বার্থ আর বাস্তবতার কথা ভাবলে তাকে পাবার কোনো কথা নয় আমার। তবু তাকেই আমার ভালবাসতে হচ্ছে। এই অনিবার্যতার জন্যেই বুঝেছি, এ আমার নিয়তি, এতেই আমার পরিণতি, এখানেই আমার ভালবাসা।”

প্রেমে পড়ার বিষয়ে পশ্চিম বাংলার সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ তার ‘একটু উষ্ণতার জন্য’ উপন্যাসে লিখেছেন- “ভালবাসা হচ্ছে তীরের মত। তুণ থেকে বেরিয়ে গেলে সে বেরিয়েই যায়। তীর তার লক্ষ্যবস্তকে বিঁধতে পারবে কি পারবে না -সেটা সেই তীরন্দাজের কপাল। কিন্তু ভালবাসা তো আর পোষা কুকুর নয় যে, তু তু করে ডাকলেই আবার ফিরে আসবে।”

পশ্চিম বাংলার আরেকজন লেখক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় তার এক উপন্যাসে লিখেছেন- “ভালবাসা মনের যে দরজা দিয়ে ঢোকে, সে দরজা দিয়ে বেরোয় না। এটা এমন একটা ইনভেস্টমেন্ট -যার কোন রিটার্ণ নেই; এমন এক পাখী -যার কোন সঙ্গী নেই।”

একজন মানুষ যখন প্রেমে পড়ে তখন তার চলার ছাঁচ কিংবা জীবনধারা বদলে যায়। প্রেম একক কোনো অনুভূতি নয়, অনেক অনুভূতির সমন্বয়ে প্রেম। প্রেমে যেমন বিশ্বাস, ভালোবাসা ও আস্থা থাকে, তেমনি হারানোর ভয় থাকে, থাকে ঈর্ষাও।

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় দেখি— কবি বলছেন, “সুরঞ্জনা ওই খানে যেয়ো নাকো তুমি/বলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে/কী কথা তাহার সাথে/তার সাথে...” (আকাশ লীনা)

কারো কারো মতে, ‘প্রেম মানুষের জীবনে অতি ব্যক্তিগত একটি আশীর্বাদ কিংবা অভিশাপ।’ প্রেমে যদি থাকে অবিশ্বাস, সন্দেহ, ছলনা ও দ্বন্দ্ব তাহলে সে প্রেম জীবনকে দুর্বিসহ করে তোলে।

অনেকে বলেন, একতরফা প্রেম অধিকাংশ মানুষকে হতাশার দিকে ধাবিত করে। এটা কখনো কখনো ঠিক। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করেছেন কিংবা নিজের জীবনকে নষ্ট করেছেন এমন উদাহরণ কম নয়। এ ছাড়া ইমোশনালি ব্ল্যাক মেইলিং ও প্রতিহিংসামূলকভাবে অনেকে অনেক কিছু করেন— যা অনুচিত এবং অনৈতিক।

আবার এমন ঘটনাও আছে, পাবে না কিংবা প্রেমে সফল হতে পারবে না জেনেও কেউ কেউ ভালোবাসে। এসব কারণে ‘একতরফা’ সম্পর্ককে ‘প্রেম’ বলতে অনেকেরই আপত্তি আছে। তাদের মতে, প্রেম কখনো একতরফা হয় না। ওটা আসলে ‘ভালোবাসা’, প্রেম নয়।

প্রেমের পরিণতি

প্রেমের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে বিরহ ও বিচ্ছেদ। বিচ্ছেদের যাতনা একতরফা ভালোবাসার চেয়েও কঠিন। বিচ্ছেদকাতর প্রেমিক-প্রেমিকাদের কাছে অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’ তা-ই এখনো অনেক প্রিয়। তবে সাধারণভাবে যেকোনো প্রেমেরই চূড়ান্ত লক্ষ্য থাকে মিলন।

কিন্তু যতটুকু জানা যায়, প্রেমিক-প্রেমিকার মিলনের পথটি অতীতেও নিষ্কণ্টক ছিল না। আদিকাল থেকেই প্রেম বা ভালোবাসার পথটি বরাবরই দুর্গম, কঠিন ও পিচ্ছিল। এখানে যেমন পারস্পরিক বিশ্বাস-অবিশ্বাস, ইগো বা দ্বন্দ্ব, সন্দেহ, ঘৃণা, ঈর্ষা ও ছলচাতুরি যেমন আছে, তেমনি মিলনের অন্তরায় হয়ে আছে ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতি, অনুশাসন এবং বৈষয়িক বাধা।

রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’র কথাই ধরা যাক। এ উপন্যাসে অমিত-লাবণ্যের মিলনের অন্তরায় হিসেবে শ্রেণী বৈষম্যকে-ই দায়ী করেছেন কোনো কোনো সমালোচক।

বিপ্লবী লেনিনের মতে, প্রেম, ভালোবাসা শুধু ব্যক্তিগত মানবিক সম্পর্কই নয়, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রশ্ন।

বৈষয়িক সীমাবদ্ধতা এবং সামাজিক রীতিনীতি ও অনুশাসনমুক্ত ‘অবাধ ভালোবাসা’য় বিশ্বাসী ছিলেন লেনিন। নারী-পুরুষের যে মুক্ত সম্পর্কের স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, সেটা কেমন ছিল?

এ প্রসঙ্গে এঙ্গেলস লিখেছেন, “এর উত্তর মিলবে নতুন বংশধররা যখন বড় হয়ে উঠবে। এক নতুন প্রজাতির পুরুষ, যারা তাদের জীবনে কখনো জানবে না— কীভাবে নারীর ভালোবাসা সম্পূর্ণ টাকা দিয়ে কিনে নিতে হয় কিংবা অন্য কোনো সামাজিক ক্ষমতার জোরে আদায় করতে হয়। অনুরূপভাবে, এক নতুন প্রজাতির রমণী, যারা কোনোদিন জানবে না— পুরুষের কাছে সত্যিকারের ভালোবাসা ছাড়া নিজেকে সঁপে দেওয়ার আর কী বিবেচনা কাজ করতে পারে। তাদের প্রেমিকের সঙ্গে মিলনে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার ভীতি প্রতিবন্ধক হয়ে উঠবে না।”

প্রেমের রকম-ফের : প্লেটোনিক প্রেম

প্রেমের মূল রহস্য আবিষ্কার করা না গেলেও প্রেমকে নানা ধরনের ব্যবচ্ছেদ তথা শিরা-উপশিরায় বিন্যস্ত করেছেন অনেকে। এর মধ্যে বয়সভিত্তিক (বাল্য ও কিশোর প্রেম, পরিণত বয়সের প্রেম, মধ্য ও প্রৌঢ় বয়সের প্রেম) প্রেম যেমন আছে, অন্যদিকে আছে প্লেটোনিক লাভ বা দেহাতীত প্রেম, একাধিক ও পরকীয়া প্রেম ইত্যাদি।

প্লেটোনিক লাভ বা দেহাতীত প্রেম, অন্যদিকে প্রেমে শরীরের ভূমিকা কতটুকু কিংবা আদৌ আছে কি না— এ বিতর্ক অনেক দিন ধরেই চলে আসছে। মতের সমর্থনে দুই পক্ষেরই যুক্তি রয়েছে। প্লেটোনিক লাভের সমর্থকরা তাদের যুক্তির সমর্থনে চেনা-পরিচিত এক বা একাধিক উদাহরণ টেনে আনার পাশাপাশি চণ্ডীদাস-রজকিনী ও দান্তে-বিয়েত্রিচের প্রেমের উল্লেখ করেন।

ফ্লোরেন্সের মহাকবি দান্তে যখন প্রেমে পড়েন তখন বিয়েত্রিচের বয়স মাত্র ৯। এরও ৯ বছর পর বিয়েত্রিচের কাছ থেকে প্রথম সম্ভাষণ লাভ করে আত্মহারা হয়ে পড়েন তিনি। তাকে নিয়ে রচনা করেন কাব্যগ্রন্থ ‘ভিটা নোভা’ (নতুন জীবন)। এদিকে বিয়েত্রিচের সঙ্গে দান্তের দেখা হয়েছিল মাত্র দু’-চারবার। ধারণা করা হয়, কবির আবেগের বিষয়ে সচেতন হওয়ার অবকাশ বিয়েত্রিচ আদৌ পাননি। সুতরাং বলা যেতে পারে, তাদের এ সম্পর্কটি স্বাভাবিক পরিণতি পায়নি। পরবর্তীকালে সাইমন নামে এক লোকের সঙ্গে বিয়েত্রিচের বিয়ে হয় এবং মাত্র ২৪ বছর বয়সে মারা যান কবির এই প্রেমিকা। বিয়েত্রিচের মৃত্যুর কয়েক বছর পর দান্তেও বিয়ে করেন গেমা নামে এক অভিজাত পরিবারের নারীকে।

অন্যদিকে চণ্ডীদাস-রজকিনীর প্রেমকাহিনীর সঙ্গে বাঙালি পাঠক মাত্রেই কম-বেশি পরিচিত। কবি বলেছেন, “রজকিনী প্রেম, নিকষিত হেম, কামগন্ধ নাহি তায়।”

প্লেটোনিক লাভের তত্ত্বে যারা বিশ্বাসী নন, তাদের কথা হচ্ছে— আগের দিনে যেসব প্রেমিক-প্রেমিকা জুটির প্রত্যক্ষ যোগাযোগের সুযোগ ছিল না, অভিসারের ক্ষেত্রে নানা ধরনের বাধা, ভয়-ভীতি, চক্ষু লজ্জা বা সংস্কার ছিল প্লেটোনিক লাভের প্রবক্তা মূলত তারাই। তবে ব্যতিক্রম তো অবশ্যই আছে।তারা শঙ্কর বন্দোপাধ্যায়-এর বিখ্যাত উপন্যাস ‘কবি’ প্লেটোনিক প্রেমের স্বার্থক উদাহরণ। পরিণত বয়সে ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ অমিত-লাবণ্যের প্রেমের সম্পর্কের যে চিত্র এঁকেছেন সেটাও অনেকটা প্লেটোনিক ধাঁচের।

প্লেটোনিক লাভ প্রসঙ্গে এ ধরনের একটি কথাও কেউ কেউ বলেন, ‘মজনু লাইলীকে পায়নি, ফরহাদ শিরিকে পায়নি, তবু তাদের মতো করে কেউ তাদের প্রিয়জনকে পায়নি।’

বিশিষ্ট পণ্ডিত প্রয়াত নীরদচন্দ্র চৌধুরী তার ‘বাঙালী জীবনে রমণী’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, “চুম্বন নিরপেক্ষ প্রেম নাই, সুতরাং দেহ নিরপেক্ষ প্রেমও নাই এবং দেহ নিরপেক্ষ প্রেম যখন নাই, কাম নিরপেক্ষ প্রেমও নাই। কারণ কাম, দেহ ধর্ম, অজেয় জীবধর্ম।”

একই প্রসঙ্গে তিনি আরও লিখেছেন, “তাই বলিয়া কাম ও প্রেম এক নয়, দুইয়ের পরিধিও সমান নয়। নর-নারীর দৈহিক সম্পর্ক মনুষ্য জাতির দিক হইতে জৈব হইলেও ব্যক্তির দিক হইতে আরও অনেক কিছু। সুতরাং দৈহিক ব্যাপারটা আনুষঙ্গিক, মনের দিক হইতে মুখ্য নয়।”

কবি মোহিতলাল মজুমদার বলেছেন, “সৃষ্টিমূলে আছে কাম, সেই কাম দুর্জয় দুর্বার।”

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি আল মাহমুদ প্রেমবিষয়ক এক আত্মজৈবনিক লেখায় বলেছেন, “এক সময় শরীরটাকেই বড় বলে ভাবতাম। আজকাল তেমন ভাবি না। ...কয়েকটি নারীর মুখাবয়ব, কারো ভেজা চোখ, দীর্ঘ ক্ষীণকায়া কারো বেণী এবং আমার পক্ষ থেকে নিরূপায় অক্ষমতার কথা জেনেও আজীবন আমাকে ক্ষমা করে যাওয়ার ঔদার্যকেই আজকাল আমি প্রেম বলে জানি।”

কবি ও প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহারের মতে, “প্লেটোনিক লাভ আজগুবি ধারণা। প্রেম মানে ইরোজ নাই, কাম নাই, শারীরিকতা নেই— এগুলো প্লেটোর কথা নয়, ছিল না। দর্শনের গোড়াতন্ত্রে, সেখানে শরীর মুখ্য বিষয়— মনুষ্য শরীর আর ব্রহ্মাণ্ড যেখানে একাকার— যা আছে ভাণ্ডে, তাই আছে ব্রহ্মাণ্ডে।”

প্লেটোনিক লাভ সম্পর্কে লেখিকা নাসরীন জাহান তার এক বইতে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি লিখেছেন, “দেহের একটি নিজস্ব ভাষা আছে, প্রকৃতি আছে। প্লেটোনিক প্রেমে বিশ্বাসী দু’জন নর-নারী যদি বন্ধনহীন একটি নির্জন স্থানে একত্র হয়, তবে কি তাদের দেহ স্পর্শহীন, আকুলতাহীন স্তব্ধ হয়ে থাকবে?”

বাংলা সাহিত্যে মানুষকে রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে সার্থকভাবে প্রথম তুলে ধরেছেন ঔপন্যাসিক মানিক বন্দোপাধ্যায়। তার ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসের নায়িকা কুসুম ও নায়ক শশী ডাক্তারের দুটি সংলাপ বাংলা সাহিত্যে বহুল আলোচিত। সংলাপ দুটি এ রকম : “কুসুম নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল- ‘আপনার কাছে দাঁড়ালে আমার শরীর এমন করে কেন, ছোট বাবু’?”

জবাবে শশী ডাক্তার বলেন, “শরীর! শরীর! তোমার মন নাই কুসুম?”

তবে ভালোবাসা যখন সত্যিকারের হয়, তখন শরীরটা অনেক নিচে পড়ে থাকে। প্রেমিকের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের পর সৈয়দ শামসুল হকের ‘তুমি সেই তরবারি’ উপন্যাসের নায়িকা সাকিনার উপলব্ধি: “ভালবাসার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। ভালবাসা এর ঊর্ধ্বেও নয়, নীচেও নয়। ভালবাসা এর বাইরে এবং বিযুক্ত।”

একাধিক প্রেম ও পরকীয়া

‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’ উপমহাদেশের বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী লতার এ গানটি শোনেননি এমন প্রেমিক বাঙালি শ্রোতা খুব কমই পাওয়া যাবে। কিন্তু মানুষের জীবনে প্রেম কি শুধু একবার-ই আসে? যারা সারাজীবনে মাত্র একবার প্রেমে পড়েছেন, সফল হয়েছেন ও সেটাকেই আঁকড়ে ধরে রেখেছেন- তারা অবশ্যই অসম্ভব ভাগ্যবান ও নমস্য ব্যক্তি।

কিন্তু যারা প্রেমে ব্যর্থ হয়েছেন কিংবা সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পরও নতুন কোনো সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেননি, তারা নিশ্চয় দুর্ভাগা। অবশ্য, এদের মধ্যে যারা নতুন করে সম্পর্কে জড়াতে চান না— তাদের কথা আলাদা।

এর বাইরে চলমান একটি সম্পর্কের ভেতর দিয়ে যারা যাচ্ছেন, তারাও প্রেমে পড়তে পারেন। তবে সমাজের চোখে এটা অনৈতিক। তবে সামাজিকভাবে স্বীকৃত না হলেও ব্যক্তি পর্যায়ে পরকীয়া প্রেমকে কেউ কেউ ‘স্বাভাবিক’ ও ‘দোষের কিছু নয়’ বলে মনে করেন।

সাধারণভাবে কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীদের জীবনে একাধিক প্রেম ও পরকীয়ার বিষয়টি বহুকাল আগে থেকেই চলে আসছে। দেশে-বিদেশে এমন কোনো বড় ও আলোচিত লেখক পাওয়া যাবে না যারা একাধিকবার প্রেমে পড়েননি।

এ বিষয়ে কবি আল মাহমুদ লিখেছেন, “হাওয়ার কাছে আদি পুরুষের যে দাবি, তা মূলত নিজের ভুলে যাওয়া রক্তমাংসের কাছেই দাবি। কবির দাবিও নারীর কাছে তেমনি। এক এক নারীর কাছে কবি দেখে তার হারানো পাঁজরেরই খণ্ড খণ্ড যোজনা। শুধু একজনের দেহে তা পাওয়া যায় না বলেই কবির কাছে কামের চেয়ে প্রেম এত বড়।”

প্রয়াত নাট্যকার সেলিম আল দীন একবার প্রেম বিষয়ক এক আড্ডায় এ বিষয়ে বলেছেন, “আমি তো এখনো প্রেমে পড়ি। সুন্দরী মেয়ে দেখলে এক ঘণ্টার জন্য হলেও আমি প্রেমে পড়ে যাই। আমি দেখেছি আমার মধ্যে প্রেম আছে। প্রতিদিন ভোরে যদি পৃথিবীকে দেখে প্রেমে না পড়ি, তাহলে আমি লিখব কেমন করে! অসম্ভব, অসম্ভব।”

সাহিত্যে পরকীয়া প্রেমের অনেক উদাহরণ আছে। রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্ট নীড়’ গল্পটি পরকীয়া প্রেমের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। রবীন্দ্রনাথের এ গল্পটি নিয়ে সত্যজিৎ রায় নির্মাণ করেছিলেন তার ‘চারুলতা’ ছবিটি। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে কুবের-কপিলার পরকীয়া প্রেমের বিষয়টি এসেছে খুবই সাবলীলভাবে।

গোপন প্রেম কিংবা পরকীয়ার কারণে রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিজীবনে খুব একটা সমালোচিত না হলেও শেষের কবিতা উপন্যাসে অমিত-লাবণ্য ও অমিত-কেতকীর সম্পর্ক ব্যাখ্যায় যে তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছেন এর সমালোচনায় মুখর সচেতন পাঠিকা ও নারীবাদীরা। উপন্যাসের নায়ক অমিত রায় লাবণ্য ও কেতকীর সঙ্গে তার সম্পর্কের বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছে— “কেতকীর সাথে আমার সম্বন্ধ ভালবাসার-ই, কিন্তু সে যেন ঘড়ায় তোলা জল, প্রতিদিন তুলব, প্রতিদিন ব্যবহার করব। আর লাবণ্যের সাথে আমার যে ভালবাসা সে হইল দীঘি; সে ঘরে আনবার নয়, আমার মন তাতে সাঁতার দেবে।”

শেষ হয়েও যা শেষ হয় না

মানুষের জীবনে ব্যক্তিগত প্রেমের অভিজ্ঞতা বড় বিচিত্র ধরনের এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা অন্তর্মুখী। আমার পরিচিত এক ব্যক্তি মাঝে মাঝে প্রেম-সংক্রান্ত আলোচনায় বলতেন, ‘আমার বুকের ভেতরটা একটা আর্ট গ্যালারি। এখানে বহু নারীর পোর্ট্রেট ঝোলানো আছে।’ এ ধরনেরই এক আলোচনায় একবার এক অচেনা তরুণকে বন্ধুদের সঙ্গে এই বলে রীতিমতো তর্ক করতে দেখেছি, ‘জীবনে লক্ষ লক্ষ বার প্রেম আসে’। হতে পারে এসব কথা শুধুই কথার কথা কিংবা অতিরঞ্জিত।

তবে এটা ঠিক যে, চলার পথে মানুষের জীবনে কখনো কখনো হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো এমন কেউ এসে পড়ে— যা মনকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়ে যায়। কেউ কেউ সেই মানুষটিকে মনে রাখে আজীবন, যা হয়তো ওই মানুষটিও কোনোদিন জানতে পারে না। এ ধরনের অনুভূতি বা সম্পর্কের নাম কী? রবীন্দ্রনাথের ভাষায় হয়তোবা এরা ‘ক্ষণিকের অতিথি’। কিন্তু ক্ষণিকের অতিথি হয়েও কেউ কেউ সারাজীবন জুড়ে থাকেন। ‘বনলতা সেন’ সেই রকমই একজন অসাধারণ নারী। কবির সঙ্গে তার দীর্ঘস্থায়ী কোনো সম্পর্ক ছিল না। তারপরও বনলতা সেন আধুনিক বাংলা কবিতায় ক্ল্যাসিক প্রেমিকার প্রতীক।

কবি লিখেছেন— “আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন/আমারে দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।/… সব পাখি ঘরে আসে, সব নদী, ফুরায় এ-জীবনের লেনদেন;/থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।”