সময় বদলায়। সময়ের গতির মুখে মানুষও বদলায়– শারীরিক নয়; চিন্তায়, অভ্যেসে,ব্যাবহারিক রীতিতে। গত কালকের মানুষটি তাই হবহু আজকের মানুষ আর নয়। তাঁর পরিবর্তন ঘটেছে,তাঁর মাঝে ভাঙচূর হয়েছে,হয়ে চলেছে । এই পরিবর্তন সামাজিক তথা রাজনৈতিক, দৈশিক এবং আন্তদেশীয়। দর্শনের নতুন ভাবনা, বিজ্ঞানের নতুনতর আবিষ্কার পুঁজির নানা স্তরিক বিকাশ মনুষ্য জীবনে যে পরিবর্তন এনেছে তা’ প্রতিদিনই বদলে দিচ্ছে সমাজের অবস্থা ও অবস্থান। তবে তার অর্থ এই নয় যে এই বদলানোর মধ্য দিয়ে মানুষ প্রকৃত স্বাধীনতা করায়্ত্ব করতে পেরেছে বা শোষণমুক্ত সমাজে প্রবেশ করে মূক্ত চিন্তায় নিজেকে বদলে নিতে পারছে । সত্য এই যে শোষণের ধারাটি বদলাচ্ছে, নতুন কৌশল আরোপিত হচ্ছে । স্বাভাবিক কারণে আমরা লক্ষ্য করতে পারি অতীতের সৃজনশীলতায় আর আজকের সৃজন কাজে প্রকাশের প্রিয়তা/অপ্রিয়তা সামনে এসে পড়ছে । আজকে কাব্য আর চর্যা যুগের নয়, শুধু মাত্র আবেগ ও নয় কিংবা দয়িতার কাছে দয়িতের রতি নিবেদনের বিষযও নয় । আজকের কাব্যে প্রকাশ, রীতি, কৌশল, বুদ্ধিদীপ্ততা আলাদা হয়ে গেছে। এর তীক্ষ্ণতা,তীব্রতা, রসবোধ, শিল্প নির্মাণ মনস্তত্ত্ব ভিন্নরকম। । তাই কবিতার শরীরে মিশেছে মানুষ, জাতি, দেশ, মহাদেশ স্বাধীনতা কতো কি ? নিজস্ব গণ্ডি ছিড়ে কবিতা হয়ে উঠছে বৃহত্তর মনোভূমি । অতীতের ধারা, আবেগ, বিষয়, বিস্ময়, হতাশা, ক্লান্তি, আশা হয়ে উঠছে তার উপজাত । ঐতিহ্যকে শক্তিমান কবিরা ব্যবহার করছেন নতুন ঐতিহ্য তৈরি করার কাজে । যুক্ত করছেন বুদ্ধিদীপ্ত কল্পনা আর নির্মাণে নতুন কৃতকৌশল। ফলে জাতীয় সংস্কৃতির রূপটি কেবল মাত্র দৈশিক নয় আন্তর্জাতিকও। বাংলা কাব্যের স্বার্থক কবিরা বর্তমানকে বের করে আনছেন তার অতীত থেকে বিশ্ব কবিতার সম্ভাবনায় । ররীন্দ্রনাথকে রোমান্টিক কবি বলেই আখ্যায়িত করা হয় যদিও ইয়োরোপের রোমান্টিক ধারার প্রায় শত বছর পরে রবীন্দ্রনাথের জন্ম তবুও তার কাব্যজগত অতিক্রম করে বাংলা কবিতা লিখে যে দাঁড়ানো সহজ নয় সে কথা আমাদের বাংলা কাব্যের নতুন ধারার কবিরা বুঝতে পেরেছিলেন এবং রবীন্দ্র-বিরোধিতার মধ্যদিয়েই স্বজ্ঞানে তাদের যাত্রা শুরু করেছিলেন । কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী ’ বাংলা কাব্যের গতি.ছন্দ,তাল-লয়, ভাব-ভাবনায় প্রচণ্ড আলোড়ন তোলে । সুধীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বিষ্ণু দে খানিকটা পরবর্তী জীবনানন্দ দাশ প্রত্যেকেই রবীন্দ্র বলয় থেকে শুরু করে তা’ থেকে নিজেদেরে মুক্ত করে পৃথক পথেই মুক্তি খুঁজেছিলেন এবং কবিতায় এনেছেন নতুন চেতনার আঙ্গিক। রোমান্টিকতার বলয় ভেঙ্গে বেরিয়ে এসেছেন আধুনিকতার সড়কে । বাংলা কাব্যের আধুনিকতার উল্লেখিত দিকপাল কবিরা তাঁদের কবিতায় নানা বিষয় আশয়কে উপজীব্য করলেও রবীন্দ্র ঐতিহ্যকে বাদ দিতে পারেন নি কবিতার অন্তজ স্বভাবের কারণেই, সমৃদ্ধই করেছেন টায় টায় নয়, পূর্ণমাত্রায় । আধুনিক কাব্য রবীন্দ্র পরবর্তী প্রথম বিশ্বযুদ্ধ উত্তর সমাজের । তবু রবীন্দ্রনাথ গুরুদেবই থেকে গেছেন স্বভাবে ও ধ্যানে । জীবনানন্দ দাশ-ই বাংলা কবিতায় প্রায় পুরোপুরি নতুন স্বভাবের স্রষ্টা, যদিও তাঁর কবিতায়ও প্রথম দিকে রবীন্দ্র অনুসরণ ছিল । এলিয়টের মতে ‘ঐতিহ্যের অর্থ পূর্বসূরীদের অন্ধ অনুসরণ নয়-ইতিহাস চেতনা ’ আলোচ্য কবি ওমর শামস ধারাবাহিকতায় তাঁদের-ই যোগ্য উত্তারাধিকারী।
‘মৌলিক শিল্প সবসময়ই তার সমকালীন মতাদর্শের সীমাকে ছাড়িয়ে যায় এবং মতাদর্শ যে বাস্তবকে আমাদের দৃষ্টি থেকে আঁড়াল করে রাখে– সেই বাস্তব দেখার অন্তরদৃষ্টি আমাদের দান করে– ’ কথা কটি আর্নস্ট ফিশারের। একটি ভালো কবিতা তা যে ভাষাই লেখা হোক না কেনো সমায়ান্তরে তা দেশ কালের গণ্ডিকে অতিক্রম করে মানবিক হয়ে ওঠে এবং কোনো বিশেষ মতবাদের যা সরাসরি রাজনীতিকে প্রাসঙ্গিক করে রচিত তার চাইতেও বেশী প্রাসঙ্গিক তার চাইতেও বেশী দূরগামী ও মানবিক হয়ে উঠতে পারে । মহাত্মা মার্কস মনে করতেন ‘সাহিত্যে আঙ্গিক ও অন্তর্বস্তুর একটা মিল থাকা উচিৎ’ । প্রবাসী কবি ওমর শামস-এর কবিতাগুলো পড়তে পড়তে মনে হয় তিনি শুধু মাত্র আঙ্গিক সর্বস্ব কবি নন, তাঁর কবিতায় যেমন আঙ্গিকের বিশিষ্টতা আছে ঠিক তেমনি আছে বহিরাশ্রয়ী সংশ্লেষণ । এই কবি দীর্ঘ সময় থাকছেন প্রবাসে । আমরা তাঁর সৃষ্টি প্রসংগে খবর তেমন একটা না রাখলেও তিনি তার নিজ জন্ম-ভূমিকে কখনো ভুলে যান নি । অনেক শক্তিমান কবির কবিতাও কিছু সময় অনেক পাঠকের দৃষ্টির আঁড়াল থেকে যেতে পারে যেমন ছিলেন জীবনানন্দ দাশ বা ফরাসী কবি বোদলেয়ার, র্যাঁবো তাঁদের সময়ে ।
ওমর শামসের লেখা-লেখি ষাটের দশক থেকে । ষাটের কবিদের মধ্যে যাঁরা খুব বেশী উল্লেখ্য এবং খ্যাতিমান তাঁদের মধ্যে মুহম্মদ নূরুল হুদা, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, রফিক আজাদ, মাকিদ হায়দার, অধিক পঠিত। ওমর শামস কাব্য-চর্চায় নিয়ত রয়েছেন প্রায় পঞ্চাশ বছরেরও বেশী । তাঁর প্রকাশিত কবিতা গ্রন্থবোধিবৃক্ষতলে, খোয়াবনামা, সত্তুরের মিছিল, রিলকের আসা-যাওয়া, কৃতি-প্রতিকৃতি, ইন্টানেট গায়ত্রী, অশোকের চাকা এবং নিউয়র্কের যিশু। পঞ্চাশ-এর অন্যতম শক্তিমান কবি শহীদ কাদরীর সংখ্যার দিক থেকে লিখেছেন অনেকের চেয়ে অনেক কম কিন্তু বাংলা কবিতা প্রসঙ্গে কথা উঠলে তাঁকে উল্লেখ না করে পারা যাবে না । কবি ওমর শামস এর কালোত্তীর্ন কবিতার ক’টি পঙক্তি দিয়ে তাঁর প্রসঙ্গে আমার মুগ্ধতার কথা বলতে চেষ্টা করছি । আমি দাবী করছি না এই আলোচনা ওমর শামস প্রসঙ্গে চূড়ান্ত তবে সূত্রপাত-তো হতেই পারে । ‘তুমি কি ধরে রেখেছ কোন প্রস্রবণ/যেখানে জন্মাবে বোধি চিরহরিৎ পত্রালির মতো/আবহমান ঋতূ সমারোহে/তীরের বেতস লতার মতো ঝুঁকে ঝুঁকে শুনবে জল কি বলে ?’ বোধি জ্ঞান যার প্রকাশ স্নিগ্ধতার প্রস্রবনের মতো ধরে রাখে অনুভব যেন বেতস লতার মতো ঝুঁকে ঝুঁকে গভীর তন্ময়তার সাথে শুনতে হয় তৃষ্ণার হেতু, জল বলবে ‘অনন্ত ঝর্নার মতো কবিতা থেকে’ এবং পঙক্তিটির পু:ণ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে অনেক বিস্ময় পাঠককে আকুল করে প্রজ্ঞার আলোক পাবার জন্য। এইভাবে কবি ওমর শামস ছড়িয়ে রেখেছেন অনেক আকুলতা অনুভব তাঁর পঙক্তিগুলোর মধ্যে । কোন হৈচৈ নেই কোন চিৎকার নেই কোন দাগ দেয়া রাজনীতি নেই অথচ সবকিছুই পাবার আছে মানবিক আকাঙ্খায়। দার্শনিক কান্টের মতে শিল্প ‘ধারণা’ থেকে বিযুক্ত শুদ্ধ সৌন্দর্য নয়, ধারণার সঙ্গে যুক্ত সৌন্দর্য ধারণা । এই কাজটুকু করে প্রতিভা , প্রতিভাই নন্দনতাত্ত্বিক ধারণাকে শিল্পরূপে উপস্থাপিত করে । গ্যয়টে মনে করতেন ’শিল্পে যাত্রা শুরু হবে সুন্দরের বিভেদক গুণ থেকে এবং তা’ শেষ হবে সৌন্দর্যালোকে উত্তরণে ’। কবি ওমর শামসের কবিতার সৌন্দর্য চেতনাটি প্রবহমান এবং ভেদ-রেখাটি বুননের মধ্যে শব্দ গাঁথূনিতে। ‘মগ্ন চৈতন্যে মাছ’ চৈতন্য যখন কোন বিষয়ে নিবিষ্ট তখন সময় ভাঙতে থাকে কিন্তু ভাবনায় সেই সময়টা ক্ষণিক এবং অন্তর-সত্ত্বায় জাগ্রত হয় বিষয়ের বহুমূখি প্রকাশ নানা প্রতীকে নানা অনুষঙ্গে । ‘একি মাছ / তুমি? ঘুমের ভিতরে ? কি করে পেরোলে লোহা-কাচ, দরোজা দেয়াল?/কোন কিমিতিতে বলো,বস্তুকে ভেদ ক’রে এলে? প্রশ্নবোধক চিহ্ন। মাছ জীবনের প্রতীক যার আসা যাওয়ার সাথে জীবন আ্ন্দোলিত হয় এবং তার আগমন নানা সংকট পেরিয়ে দরোজা, দেয়াল বস্তুকে ভেদ করে একটা দৃশ্যের পরে আরেকটা প্রসঙ্গিক দৃশ্য মনস্তত্ত্বের আগল উপড়ে ‘না আঁধারে না আলোয়/আমার ছোট্ট ঘরে অর্থাৎ অস্তিত্ত্বের সংকট কিন্তু আকাঙ্খার দূর্বারতা ‘আমার ছোট্ট ঘরে ঘরময় হয়ে আছে’ সামাজিক অবস্থানের ক্ষুদ্রতার গণ্ডি ভেঙে ঘরময় হওয়া বৃহতে ছড়িয়ে যাওয়া । তারপর ‘অতি আরো অতি তরঙ্গের আলো এসে পড়ে’ এই ভাবে কবি বুনেছেন তাঁর চিন্তার কাঠামো এবং এভাবে শেষ করেছেন কবিতাটি ‘আমরা কি স্খলে গেছি সূর্য-বলয়/দূরতর মহগ্রহে মহা-জিজ্ঞাসায়!’ ওমর শামস-এর কবিতায় একটি বিষয় খুবই লক্ষণীয় যে তিনি বিমূর্ততার কবি নন, তিনি অসাধারণ কাব্য-শক্তির দ্বারা প্রায় প্রতিটি কবিতায় পাঠকের নিজ চিন্তাউদ্রেকের অবকাশ রেখেছেন । তাঁর নির্মাণ কৌশলে আছে ভাবকে গতিমূখী করার জন্য শব্দের প্লাবন যা কবিতাকে বহুমূখী করেছে । প্রয়াত কবি হুমায়ুন কবির কবিতাটি দুটি উপ-শিরোনামে গ্রন্থিত ১. কল্পনা ও বাস্তব ২. তমসায় হত্যা দুটো উপ-শিরোনামে বাস্তব শব্দটি এসেছে সংগতির মধ্যের ভাবনা এবং বেদনার বাস্তবতায় যার উভয় প্রান্তে রয়েছে বিভ্রমের যুক্ততা । সংগতির বাস্তবতা অস্তিত্বের অবস্থানে বিরাজমান, মানুষের সকল আশায় যার বিস্তার তার ভিতরের বাস্তবতায় – যে বাস্তবতা উদ্ধারে কবি হুমায়ূন কবির ব্রতি হয়েছিলেন , ঘাতকের বুলেটে প্রাণ দিয়েছিলেন। কবি তাকে উপলক্ষ্য করে কবিতাটি রচনা করেছেন যার শুরুটা এ’ভাবে ‘আপনি কি মার্ক্সিস্ট/এই বলে চলে গেলো চোখের ভেতরে…তার পর বুনন হয়েছে কাব্য কাঠামো। শরীরে এসে বসেছে ঝাঁকে ঝাঁকে শব্দ যেন বর্ষা-ধারার মতো নেমে এসেছে চেতনা থেকে নানা অনুষঙ্গে । ‘সত্যি না মিথ্যা/বিশ্বাস না বাতুলতা/তদবিরি না তেজারতি/মন্ত্র না মাতবরি/দেশ না দশ/দশ না কোটি…নদী-দহ বিল-চর পলি-গ্রাম গঞ্জ ও বন্দর/সে ঘুরে ছিলো.. কল্পনা তাকে দিয়েছিলো মহিমা/বাস্তব তাকে দিয়েছিলো দার্ঢ্য। ‘খন্ডের মধ্যে অখন্ড অপূর্ণতার ভেতর পূর্ণের অবস্থান আমরা লক্ষ্য করতে পারি’ ।
বাংলা কাব্য আলোচনায় আধুনিক কবিতা প্রসঙ্গ উঠলে পশ্চিমের সাহিত্যকে সুত্রবদ্ধ করে আলোচনা করা হয় এই বলে যে রোমান্টিক যুগের অবসানে আধুনিক কবিতার ভিত্তি রচনা করেন টি.এস. এলিয়ট, তার কবিতা বাংলা কাব্য জগতে বিরাট প্রভাব ফেলে এবং বাংলা কবিতায় তার প্রভাব লক্ষণীয় । সন্দেহ করার কারণ নেই যে ইংরেজী সাহিত্য তখন এখানে পঠন শুরু হয়েছে, তার প্রভাব যে কবিদের লেখায় পড়েনি তাও নয় তবে সুধীন্দ্রনাথের তন্বী বুদ্ধদেব বসুর মর্মবাণী, বন্দীর বন্দনাজীবনানন্দ দাশের ঝরা পালক ও ধুসর পান্ডুলিপি ইত্যাদি ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে । ‘তেইন’ মনে করতেন শিল্প হলো অনুকৃতি। এই অনুকরণের ফলে বস্তু ও বাস্তবতা চিত্রে স্বজ্ঞাত হয় : মৌলগুণের যদি অনুকরণ করা যায় তা’হলে বস্তুর বাস্তবতা চরিত্রে উদ্ঘাটন সম্ভব’। কবি ওমর শাসম তাঁর শিল্প নির্মাণে নানা রকম কাব্য-প্রকরণ ব্যবহার করেছন। অক্ষরবৃত্তে চলতে চলতে বেছে নিয়েছেন অসম মাত্রাবৃত্ত আবার স্বরবৃত্তও ব্যবহার করেছেন দীর্ঘ কবিতায় পর্ব বিভাজনে । তবে সব কিছুই করেছেন বাংলা কাব্য-কাঠামোকে অটুট রেখে এবং ঐতিহ্যকে সাঙ্গিকরণের মাধ্যমে।
ওমর শামসের খোয়াবনামা কাব্য প্রসংগে খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস মন্তব্য করেছেন এভাবে ‘ মাটির ভেতর ঢুকে তার স্তরে স্তরে গড়িয়ে পৃথিবীর শাঁস স্পর্শ করার ইচ্ছা তাঁর যেমন প্রবল আবার হাতের নানা রকম ব্যবহার কি বিচিত্র রকম ডাইনিং টেবিলের বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনার মধ্যে সামাজিক অসঙ্গতির প্রতি তাঁর ধিক্কারও তীব্র’ …তাঁর কাব্য কোন দার্শনিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না কিন্তু যে অনুসন্ধান কবিতাগুলোর পরতে পরতে অস্থির আলো ফেলতে ফেলতে এগিয়ে চলে তা যে কোন পাঠককে তার নিজের ভেতর তাকাতে প্ররোচিত করবেই’। খোয়াবনামা কাব্যে কবি মানুষের খোয়াব বা স্বপ্নকে বিধৃত করেছেন পরিপুষ্ট করেছেন। এই খোয়াব মানুষের সারা জীবনের একরাত্রির নয় বা ক্ষনিকেরও নয় । এই প্রসঙ্গে প্রায়ত কবি প্রাবন্ধিক আবদুল মান্নান সৈয়দ উল্লেখ করেছেন ‘খোয়াবনামা আমাদের দেশের জনগণের মধে প্রচলিত। অনেকের বাড়িতে খোয়ানামা ব্যবহৃত হয় । কিন্তু এখানে তিনি যে ভাবে ব্যবহার করেছেন সেটা সম্পূর্ন আলাদা– তার সংগে যুক্ত হয়েছে গণ-মানুষ , শেষ পর্যন্ত সেই ভাতের স্বপ্ন-সিঁদচোর, সে স্বপ্ন দেখছে কাঁসর ঘটি-বাটি আর সাধারণ-মানুষ স্বপ্ন দেখছে ভাতের’ কবি প্রান্তিক অবস্থান থেকে কবিতাটিকে বিস্তৃত করেছেন, মানগোষ্ঠির খোয়াবের দিকে নিয়ে গেছেন দেশ কালের গন্ডি পেরিয়ে । খোয়াবনামা শুরু হয়েছে এভাবে ‘নক্ষত্রের তলে কেহ জেগে নেই/জেগে নেই আজ রাতে’ দৃশ্যমান দূর অংশ এবং
অস্তিত্বের শরীর গড়ে ‘মানুষ মানুষের যতো সাধ’ দিয়ে সামনে এগুনো এবং তার পর অযুত-অযুত এর মধ্যে হাইফেন দিয়ে যূথ শব্দ অযুতের যোজক হিসেবে ব্যবহার জীবনানন্দের মতো দক্ষতা পেয়েছে ‘কখনো কখন’ সাধারণ দুটি শব্দ কিন্তু মাত্রা পেয়েছে ভিন্ন দ্যোতনায় । শব্দ দিয়েই প্রকাশ করতে হয় এবং ভিন্নতা বিভ্রমে নয়, নিয়ে যেতে হয় বাস্তবতায় শিল্প সুবাসে । সাহিত্যদর্পনপ্রণেতা কবিরাজ বিশ্বনাথ এর কাব্য সংজ্ঞায় কাব্য হইতেছে দোষহীন গুণযুক্ত শবদার্থযুগল, যাহা কখনো কখনো অলঙ্কার শূণ্যও হইয়া থাকে’ তাঁর মতে ‘রসাত্মক বাক্যই কাব্য’। দৃশ্য চিত্রায়নে ওমর শামস নিপূণতার পরিচয় আমরা পেতে পারি ‘একটি শিশু জেগে উঠেছে কবর থেকে/চিৎকার করে উঠেছে/কেননা পাথর ঠেকেছে তার কনুই-এ. তার পর সে কিছুতে-ই হাত বাড়াতে পাছে না /একটুকরো রুটির দিকে ’ প্রথমে ‘ শিশু জেগে উঠেছে কবর থেকে ’বাস্তবতার বিভ্রম ’ আবার শ্বাশত সেই দাবী রুটির দিকে হাত বাড়িয়েছে– অপূর্ণতা থেকে পূর্ণতায় পৌঁছানো অদ্ভুত এক ইমেজে দৃশ্যমান হয়েছে বাস্তবতা চিরকালীন সত্যের সত্য ‘রুটি’ । প্রুফ্রকে যেমন কোন ব্যক্তির কথা বলা হয়নি বলা হয়েছে যুগের হতাশার কথা তেমনি খোয়াবনামা গ্রামীন জীবনে মানুষের ঘরে রাখা খোয়াব বিশ্লেষনের বই নয়, বরঞ্চ মানুষের জীবনের কথা, কাহিনী, সংগ্রাম, স্বপ্ন, বাস্তবতা, বিভ্রম, ইত্যাদির নকশী কাঁথা । চিত্রকল্পের পর চিত্রকল্প এবং ইমেজ তৈরীর মাধ্যমে বয়ানের মতো করে বলে গেছেন কবি । উল্লেখ্য খোয়াবনামা নামে পরবর্তিতে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস লিখেছেন তাঁর বিখ্যাত ঊপন্যাস ।খোয়াবনামা একটি মহৎ কবিতা এবং বিন্যাসের দিক থেকে অংকন শিল্পের ধারা ব্যবহার লক্ষ্য করার মতো ।
রিলকের আসা-যাওয়া প্রসংগে প্রয়াত কবি আব্দুল মান্না সৈয়দ উল্লেখ করেছন
রিলকের আসা-যাওয়াআগের তিনটি কাব্য থেকে আলাদা, তিনি চলে এসছেন অন্য জায়গায় । বোঝা যাচ্ছে তাঁর মানস-সচলতা আর সৃষ্টি সচলতা এগিয়ে চলেছে । স্বোপার্জিত মনি-মুক্তা এখন তাঁর কবিতার শব্দে, শব্দের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্পেসে, আত্মায় ছড়িয়ে পড়েছে । …… ‘দেশটা দেখে আসি’ (বই-এর প্রথম দুটি কবিতা) কখনও সাত মাত্রার মাত্রাবৃত্ত আর স্বরবৃত্তের গাঁথা জীবন্ত-প্রমূর্ত হয়ে ওঠে । … ‘এলুয়ার, তোমার কবিতার গান মনে এলো’ বিদেশের সংগে বাংলাদেশে মিলে-মিশে একাকার… সমস্তই সম্পন্ন হয়েছে বুদ্ধি বলে নয়-হৃদয়ের দ্বারা মথিত ঝংকৃত চমৎকৃত’ ‘বকফুল ভাঁট ফুল বকুল বকুল/উড়ে উড়ে/লেখে নাম লেখে নাম লেখে নাম/বার্চের তলে স্তুপ/বটপাতা /আমপাতা/জামপাতা/লেখে নাম লেখে নাম লেখে নাম/এলুয়ার তোমার কবিতার গান’। বার্চের তলে স্তুপের পর /বটপাতা/আমপাতা/ জামপাতা এরকম ঘাস চুল নাড়ে/ওক মাথা নাড়ে বিদেশ এবং স্বদেশকে যুক্ত করে দেয় এবং দুটি সংস্কৃতির ধারাকে ফ্রেমবদ্ধ করে বাঙালিয়ানায়। কবি শব্দের মাঝে আরেক শব্দ পর্যন্ত যে স্পেস বা শব্দের মধ্যে কোনো কোন শব্দে অক্ষরকে ভেঙ্গে যেমন ‘আ-কাশ’ লিখে তাঁর চলমানতায় পরবর্তী ভাবনা ছড়িয়ে রেখেছেন । ‘দেশটা দেখে আসি’ প্রথম কবিতায় ‘হাতগুটায় কারা হাত গুটায় /দিন আসছে /দিন আসছে’ দিন-এর পরে স্পেস দিয়ে আসছে ব্যবহারে আশা এবং নিশ্চিতির ভাবনা ছড়িয়ে আছে ।
ক্রিস্টোফার কডওয়েল ভাষায় শিল্প হলো অনুভূতির বিজ্ঞান, বিজ্ঞান হলো জ্ঞানের শিল্প । কিছু করতে হলে আমাদের জানতে হবে এবং কী করতে হবে সেটা অনুভবও করতে হবে । কবি ওমর শামসের কবিতা পাঠে এ বিষয়গুলো উপলব্ধি করা যায় বিশেষ করে তাঁর নিউইয়র্কে যিশুকবিতাটি পাঠে । কবিতাটি কাহিনী কাব্যের বাঁধুনিতে গ্রন্থিত । দু’হাজার বছর আগের মানুষ যিনি নিউইয়র্কের রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছেন রক্তাক্ত পায়ে তাঁর গায়ে ধূসর চিবর, মাথায় কাঁটার মুকুট, ক্ষত পা থেকে ঝরছে রক্ত যেনো কালের কিম্ভূত তিমি তাঁকে উগরে গেছে সে আর কেউ নয়;যিশু–ধনতন্ত্রের ঝলমলে শহরে এসে পৌঁছেছেন অনেক হেঁটে এবং মানব ইতিহাসের অসংখ্য হানাহানি, কাটাকাটি ছিনা-ছিনির শেষে নতুন নিয়মে ছিনা-ছিনির বৈধতা /অবৈধতা দেয়ার প্রষ্ঠিান আজকের জাতীসংঘ তার পতাকাতলে । রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন তার পতাকাতলে । যেখানে বসে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, ফিশফাশ হচ্ছে, স্বার্থসিদ্ধির ছক হচ্ছে, সন্ধি হচ্ছে ভাগবাটোয়ারার। মানচিত্র ভাঙছে,আর ব্যবিলন, মেম্ফিস,ঊর, সুসা, নিশাপুর প্রাচীন নতুন সর্বত্র গোঙানী,চিৎকার । এখানে যিশু ব্যবহারের পর্যায়ে উপনীত এবং তার পতাকাতলে উপস্থিত হওয়া প্রতীকি অর্থে যিশু দখলকে বুঝানো হয়েছে । এই কবিতায় বিধৃত হয়েছে কাল, দূরকাল, সমকাল এবং আগামী একই রৈখিক টানে । মানুষ, মানুষের জয় পরাজয়, অনুভব, ইতিহাস ভূগোল দেশ মহাদেশের বিস্তৃতিতে । ‘তিনি জানেন না কোন চক্রে, কোন শর্তে শনিসহ বৃহষ্পতি ঘোরে/অদিতি ভোর হতে আজকের ভোরে ’। কবি আপন ভঙির মতোই এই কবিতার শরীরও নির্মাণ করেছেন ঝাঁকে ঝাঁকে শব্দ সৈন্য ব্যবহার করে । তিনি বিরাম দেন নি কোথাও কারণ তা’হলে পাঠককে যে বিষয়ের সংগে যুক্ত করতে চেয়েছে তা’ হলো ইতিহাস–ছেদ হয়ে যেতো । এই কবিতাটি বর্তমান সময়ের মানবিক দলিল যা যিশুর হেঁটে যাবার আবহের মধ্যদিয়ে বিবৃত হয়েছে । এখনো ডকের পরে নিগ্রোর নিলামের/ইরাকোয়া-চিরকির চিৎকারকে আবহ করে বিশ্বায়নের অন্তসারশূণ্যতার অর্থপূর্ণ ইঙ্গিত । খুন ঝরে খালি পায়ের দু’হাজার বছরের, খুন ঝরে অনন্ত কাল ধরে আর যিশুরা মুক্তির কথা বলে রক্ত ঝরায় এবং তারপর ব্যবহৃত হয় ।
ওমর শামস নিশ্চয়ই তাঁর পাঠককে আন্দোলিত করতে পেরেছেন, করবেন আরো সকল আগামীতে ।
সহায়তা:
আধুনিক কবিতা, ড.দিপ্তী ত্রিপাঠি।
ইলিউশন এন্ড রিয়ালিট, ক্রিস্টপার কডওয়েল ।
ক্রোচের নন্দন তত্ত্ব,সুধীর কুমারনন্দী ।
বিদ্রোহী কবিতা প্রসংগে, কবি মুহম্মদ নূরুলহুদা।
রবিউল, পড়ে খুশী এবং অবাক হলাম। ইমেইল দিয়েছি তোমাকে । উত্তর দিও, আরও আলাপ হবে। ধন্যবাদ। - ওমর শামস
উত্তরমুছুনতোমাকে খুঁজছি, এখনো পাওয়া যায় নি। talukdar48@gmail.com .. ওমর শামস
উত্তরমুছুন